Tag Archives: surma river

টাঙ্গুয়ার হাতছানিতে বর্ষাকালেই গেলাম

২০শে জুন, ২০১৩, রাত ২টা…স্কাইপেতে আরিফের সাথে কথা হচ্ছিল, টাঙ্গুয়ার হাওড়ে যাওয়ার কথা সেই তখন বলল। এক কথায় রাজী হয়ে গেলাম। ২৭শে জুন, ২০১৩, বৃহষ্পতিবার দুপুরে যাত্রা করব।
২৭শে জুন, ২০১৩, বৃহষ্পতিবারঃ
সকাল ১০টা ৩০মি-এ আরিফের ফোন, ‘কিরে কখন হলে আসতেছোস?’ কথামত দুপুরে ১:৩০ মিনিটে বের হয়ে গেলাম। হলে এসে খাওয়া দাওয়া করলাম। খেতে খেতে শুনলাম, কিভাবে দল ছোট থেকে ছোটতর হইছে। ১২ জন থেকে কিভাবে ৬জন হল, এর মধ্যে আবার দুইজন ৫০-৫০ চান্স। যাইহোক, ৪ টার দিকে অভি গাড়ী নিয়ে হলে হাজির। ১০মিনিটের মধ্যে রওনা দিলাম। জ্যাম ঠেলে সিলেট যখন পৌছলাম তখন বাজে রাত ১১:৩০। চট্টগ্রাম থেকে মামুন ভাই দুপুরেই সিলেট পৌছেছেন। উঠেছেন সার্কিট হাউসে। যাইহোক, রাতের খাবারের জন্য হামলা দিলাম অভির এক বন্ধুর বাসায়। খিচুড়ী, গরুর মাংস খেতে খেতে টেনশন করলাম গালিব ও তুষার-কে নিয়ে, আদৌ আসবে তো? খাওয়া শেষ করে ঘাটি গাড়লাম সার্কিট হাউস। ঘড়িতে তখন রাত ২ টা। সুরমার পাড়ে বসে আমি, আরিফ ও মামুন ভাই আড্ডা দিচ্ছি, সিগারেট পোড়াচ্ছি। সাথে সাথে পরের দিনের প্ন্যান করে ফেললাম। যখন ঘুমাতে গেলাম তখন বাজে রাত ৩টা ৩০মিনিট। 20130628_064648

২৮শে জুন, ২০১৩, শুক্রবারঃ
মামুন ভাইয়ের ডাকে ঘুম ভাঙল, ‘কিরে ওঠ, গালিব ও তুষার নাচতে নাচতে চলে আসছে। তোরা মাছের আড়ৎ যাবি না। ৭টা বাজে’। কে শোনে কার কথা, আরও কিছুক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি করে ৭:৩০ মিনিটে লাফ দিয়ে উঠলাম। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্যঃ পশ্চিম কাজীর বাজার, মাছের আড়ৎ। যাইহোক, আসা ব্যর্থ হল কারণ এখন পাবদার সময় না। যা আছে সব ভারতীয় পাবদা। এদিকে ক্ষুধায় মাথা নষ্ট। আমি, আরিফ নাস্তা করতে ঢুকে পড়লাম এক হোটেলে, মামুন ভাই রুমে চলে গেলেন সাড়া দেয়ার জন্য। সবকিছু শেষ করে, মাইক্রো বাস ঠিক করে যখন সুনামগঞ্জ-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম তখন বাজে ৯টা ৩০মি। বলে রাখি, মাইক্রোবাস ভাড়া করছি মাজার গেইট থেকে, ১৩০০ টাকা।
যাওয়ার পথে ‘তারাদিন’-এর সামনে দাড়ালাম বাজার করার জন্য। টি ব্যাগ, চিপস, কন্ডেন্সড মিল্ক, চিনি, পানি, জুস, টয়লেট টিস্যু এইসব টুকটাক জিনিস কিনে ফেললাম। এছাড়াও ফার্মেসি থেকে নাপা, এন্টাসিড, স্যালাইন, ভিক্স, স্যাভলন ক্রিম, ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ নিয়ে নিলাম। আখালিয়া থেকে মামুন ভাই ও অভি-রে পিক করা হইল, তাদের মিশন সফল। একটা গীটার জোগাড় করা গেছে। এখন শুধুই এগিয়ে চলা। মাইক্রো-তে বসে থাকতে থাকতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙলে দেখি দাঁড়িয়ে আছি জ্যামের মধ্যে। মামুন ভাই এসে বলল জ্যাম না, বাস একটা রাস্তার উপর আড়াআড়িভাবে দাঁড়িয়ে আছে। বাসের ড্রাইভার বনাম রাস্তার শ্রমিক গণ্ডগোল। সবাই নেমে পড়লাম। যে যার মত হাঁটছি আর আমি ছবি তুলছি। হাঁটতে হাঁটতে আমি ও আরিফ সামনের ব্রিজ পার হয়ে একটা চায়ের দোকানে ঢুকে পড়লাম। একটা চায়ের দোকান না বলে, বলা উচিৎ একমাত্র চায়ের দোকান। এখানে সময় নষ্ট হল প্রায় ১ থেকে দেড় ঘন্টা। পুলিশ এসে অবস্থা স্বাভাবিক করার পর আবার যাত্রা শুরু করলাম। ঘড়িতে তখন প্রায় ১২টা। আর কোন অঘটন ছাড়াই বেলা দেড়টার দিকে পৌছলাম সুনামগঞ্জ সুরমা নদীর ঘাটে।
কপালের নাম গোপাল। এসে দেখি নৌকাটা মাত্র ছেড়ে গেল। কি আর করা, কমপক্ষে ৩০মিনিট লাগবে ওই পাড় থেকে ঘুরে আসতে। এই সুযোগে পেট পুজা সেরেনি। ঘাটের কাছে হোটেলে দেখি পুরি ভাজছে, সবাই পুরি খেতে লেগে গেলাম। গালিব একটা সিঙ্গারা নিল, সবাইকে ভাগ করে দেয়ার পরও শেষ হইলো না। এদিকে বৃষ্টিতো পড়েই যাচ্ছে। এই পড়ছে, আবার ক্ষরা দিচ্ছে, আবার পড়ছে। সোজা কথা, আমাদেরকে বাগে পেয়ে যা ইচ্ছা করতেছে। মাথায় কেপ পরে নিলাম আর আমার কাছে রেইনকোট ছিল, তাও গায়ে উঠে গেল। নৌকা আসলে ঝটপট উঠে গেলাম। সবার আগেই উঠলাম, তাই দাঁড়িয়ে আছি দাঁড়ের কাছে। দেখি মাঝি আমাদের দিকে কি যেন ইশারা করছে। কিছুই বুঝলাম না, তাকিয়ে আছি কি বলতে চাচ্ছে বোঝার জন্য। স্থানীয় এক লোক আমাদের সাহায্যে এগিয়ে এল। ঘটনা হল নৌকা ঘোরাবে, তাই আমাদেরকে ঈঙ্গিত করছিল দাঁড় ডানে ঘোরানোর জন্য। মাঝির সাথে কথা হল। কোথায় যাব, কি জন্য আসছি এইসব। মাঝি বলল, ‘শক্ত হয়ে দাঁড়ান, না হলে পড়ে যাবেন। ঘাটে ভিড়ব এখন’। আসলেই কেয়ারফুল না হলে হয়ত যে কেউই পড়ে যেতে পারে।
ওপার নেমে দেখি, মামুন ভাইয়ের এক বন্ধুর সহায়তায় আগে থেকেই তিনটে মোটরবাইক ভাড়া করা হয়ে গেছে। যাব টেকেরঘাট। এক বাইকে দুইজন উঠব প্লাস ড্রাইভার, মোট তিনজন, আছে ব্যাগ, গীটার, বাজার এবং বৃষ্টি। কি আর করা, উঠে পড়লাম। এক বাইকে আমি ও আরিফ, আরেকটাতে মামুন ভাই ও অভি, অন্যটাতে গালিব ও তুষার। মোটের উপর, মোটা ও চিকন কম্বিনেশন। গীটার আমার হাতে আর বাজার ভাগে ভাগে নেয়া হল। খুব হালকা বৃষ্টি হচ্ছিল। আমরা বাইকের পিঠে বসা, বেশ রোমাঞ্চিত হচ্ছি আবার ভয়ও হচ্ছে। রোমাঞ্চে পানি ঢেলে দিল বৃষ্টি। ঝুমায়ে বৃষ্টি নামল। তাড়াতাড়ি একটা বাজারে দাঁড়িয়ে পড়লাম, আশ্রয় নিলাম এক দোকানে। বৃষ্টিতো পড়েই যাচ্ছে, মুষলধারে (কুকুর-বিড়াল বৃষ্টি)। একঘন্টা পার, বাবাজি বৃষ্টির থামার কোন লক্ষণ নাই। বসে বসে প্রাণ মামা ওয়েফার এক প্যাকেট প্লাস ছয়টা সাবড়ে দিলাম, কিন্তু বৃষ্টির কি আর সেদিকে কোন খেয়াল আছে। মামুন ভাই বলল, ‘চল বসে থেকে কোন লাভ নাই, রওনা দিয়ে দিই। যা হবার পরে হবে। আমার রেইনকোট গায়ে উঠল, মাথায় কেপ কিন্তু বাকি সবাই শুধু মাথায় কেপ। সব মোবাইল পলিথিনে, ব্যাগ আছে পিঠে যা ভিজে যা থাকে। আমার ব্যাগে আবার লেপটপ আছে। ভাল তো, ভাল না…
যাই হোক, বৃষ্টিকে বুড়া আঙ্গুল দেখিয়ে ভিজে ভিজেই যাচ্ছি। প্রায় ১৫/২০ মিনিট যাওয়ার পর এক বাজারে পৌছলাম। আমাদের বাইক সবার সামনে, হঠাৎই দাঁড়িয়ে পড়লাম এক দোকানের সামনে। সবাই এসে থমকে দাড়ালো, বড় চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
– ‘প্লাস্টিক কিনব। ওইতো দোকানে প্লাস্টিক দেখা যাচ্ছে’।
সবাই যেন প্রাণ ফিরে পেল, চাবি দেয়া পুতুলের মত সুরসুর করে দোকানে ঢুকে পড়ল। ২ গজ প্লাস্টিক নিলাম গীটারের জন্য আর প্রতিটি ব্যাগের জন্য এক গজ করে। প্রতি গজ ১২ টাকা। মোট ৯৬ টাকার প্লাস্টিক কিনলাম। ব্যাগ ও গীটার প্লাস্টিক দিয়ে রিপ্যাক করে আবার বাইকে উঠে পড়লাম। এবার আর কে পায় আমাদের, ধুমায়ে বৃষ্টি হচ্ছে তো কি, ব্যাগ নিরাপদ, নিজেরা কাক ভেজা ভিজছি তো কি হয়েছে। বেশ দ্রুত ছুটে চলছি আমরা। একটা কালভার্টের অবস্থা এত খারাপ যে নামতে বাধ্য হলাম। পিছনে তাকিয়ে দেখি আমাদের বাকি দুই বাইকের কোনটারই দেখা নাই। ব্যাপার কি, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। দেখি একদল আসছে। তাদের কাছে শুনলাম অন্য বাইকের চালক এদিকের রাস্তা কম চেনে, তাই পথ ভুল করছিল। যাই হোক তাকে, মাঝখানে থাকতে বলে আমারা রওনা দিলাম। এক জায়গায় এসে মনে হল যাত্রা শেষ বুঝি, অদ্ভুত সুন্দর। এক মেঘ তারপরও কেমন যেন সেজেগুজে সাদা হয়ে বসে আছে। Seeing is believing…trust me, wish u guys could c that place at that time…

near-jadukata
যাদুকাটা নদী। বাইকে করে নদীর ধার পর্যন্ত গেলাম কিন্তু ঘাটের একটু আগেই নামতে বাধ্য হলাম কারণ কাদা, পাথর। যাই হোক, বৃষ্টি কিছুটা কম। এত সুন্দর জায়গা, কোন কিছু তোয়াক্কা না করে ছবি তুলছি। লেন্সের সামনের পলিথিন ছিড়ে ফেললাম, যা আছে কপালে। ছবি তোলা শেষ করে ঘাটের দিকে হাটা দিলাম। শেষ মুহুর্তে গিয়ে নৌকায় উঠলাম। গালিব তখনও এসে পৌছায় নাই, এদিকে নৌকা ছেড়ে দিচ্ছে। ডাকাডাকি শুরু করলাম, মাঝি ও যাত্রিদের বুঝিয়ে গালিবরে নৌকায় উঠালাম। তখনও অভি ও মামুন ভাইদের কোন খবর নাই। নৌকা ছাড়ার পর দেখি তাদের বাইক আসছে। কিন্তু কিছু করার নাই আমাদের, ওপারে অপেক্ষা করা ছাড়া। কিছু ছবি তুললাম নৌকায়। নৌকা থেকে নেমে আবার চা খেলাম সবাই মিলে এবং অপেক্ষা করছি মামুন ভাইদের জন্য। এই ফাঁকে আরও কিছু ছবি নিলাম। মামুন ভাইরা আসলে শুনলাম, ওনাদের চালক আবার পথ ভুল করে ওনাদের প্রায় বর্ডারের কাছে নিয়ে গেছিলো। সবাই হাসাহাসি করতেছি, ওদিকে অভির মেজাজ খারাপ, ‘আমি মামুনের লগে নাই, ও হইতাছে কুফা দা গ্রেট। আসার সময় ওর ট্রেন ৭ঘন্টা দেরী করছে, এখন বাইক পথ ভুল করে বর্ডারের কাছে চলে যায়’।

20130628_144156
যাই হোক, আবার যাত্রা শুরু হইল। পাহাড়ের ওপর থেকে নিচের সমভূমি অদ্ভুত সুন্দর লাগে দেখতে। আবার বাইক দাঁড় করিয়ে কিছু ছবি নিলাম। বৃষ্টি মনে হয় আমাদের কথা ভুলে গেছে, আর পড়ছে না। হালকা হালকা রোদ উঁকি দিচ্ছে। চালককে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আর কতক্ষণ লাগবে’? উত্তরে ২০ মিনিট লাগবে বলে জানালো। কিছুদূর যেতেই জানতে পারলাম, রাস্তার দুপাশেই কয়লা তোলা হচ্ছে। দেখে তেমন কিছু মনেই হলো না। এভাবে প্রায় ৩০ মিনিট চলার পর সামনে দেখি পাহাড়ের পানি নামছে, কোন নদী কিনা জানা হয়নি কিন্তু বেশ খরস্রোতা ছিল। আমাদের বাইকের চালক আমাদেরকে নিয়েই লাফ দিয়ে নেমে গেল ওই শ্রোতের মাঝে, তার উপর নিচে সব পাথর। বাইকের চাকা হড়কে গেল, কিছুক্ষণ নিয়ন্ত্রণবিহীন দৌড়াদৌড়ি করল। ভাবছিলাম একবার পড়তেই হবে। কিন্তু কপাল ভাল, চালক নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাইছিল। কোনমতে হাটু সমান খরস্রোতা পানির মধ্যে দিয়ে বাইকে করে পাড়ি দিলাম আমরা। আমাদের এই অবস্থা দেখে পেছনের দুই বাইক সাবধানে নামল, তাও যাত্রীরা আগেই নেমে গেল এবং ছোট ব্রীজ দিয়ে জায়গাটা পেরিয়ে এল।
আরও কতক্ষণ লাগবে জানতে চাইলে, উত্তর পেলাম যে এখনও ১০ মিনিট। কি আজব রে ভাই, ২০ মিনিটের জায়গায় আধ ঘন্টা চলার পরও আরও ১০ মিনিট। কি যে আছে কপালে কে জানে। আবার যাত্রা শুরু করলাম। শেষ পর্যন্ত যখন টেকেরঘাট পৌছলাম তখন ঘড়িতে বাজে ৪টা আর আমাদের অবস্থা ১২টা।
কোন দিকে না তাকিয়ে চটপট আগেই ভাড়া করে রাখা নৌকায় উঠে পড়লাম। ওঠার আগে হাত-মুখ ধুয়ে নিলাম। ওঠা মাত্রই নৌকা ছেড়ে দেয়া হল। যাব টাঙ্গুয়ার হাওড়।
সবাই পানিতে নামার জন্য অস্থির হয়ে আছি অথচ কেউই ভাল সাঁতার জানি না। অদ্ভুত! যাই হোক, হাওড়ে যাওয়ার আগে বাজার করতে হবে কারণ এখন থেকে নৌকাতেই ঘরবাড়ি। তাই শেষ বাজার থেকে খাবার-দাবার, কাঁচাবাজার করতে হবে। ঘাটে এসে মামুন ভাই ও আরিফ বাজারে চলে গেল। আমিও কিছুক্ষণ পর নেমে পড়লাম। ছুরি, আম, ১ কেজি বাদাম কিনে ফেললাম ঘুরে ঘুরে। আরিফরাও ইতিমধ্যে বাজার শেষ করে ফেলল। নৌকা ছাড়া হল, এমন সময় দেখা গেল চাল-ই কেনা হয়নি। নৌকার একজন দৌড়ে গেল বাজারে। মামুন ভাই আরিফরে ধুচ্ছে, ‘তোরে না কইলাম কিনতে। তুই কিনছ নাই কেন’?
‘আপনে আমারে গরম মসলা নিতে কইছেন শুধু। আমার কি দোষ’।
যাই হোক, বাজার করা শেষ করে রওনা দিলাম। ঘড়িতে তখন সাড়ে পাঁচটা।
টাঙ্গুয়ার হাওড়ঃ

20130628_175903
যাও একটু রোদ ছিল তাও গেল, আকাশ মেঘ মেঘ করছে আবার। দেখি পানির রং হলুদ থেকে হালকা সবুজ হচ্ছে। মাঝি বলল আমারা হাওড়ে চলে এসেছি। এখন শুধুই তাকিয়ে থাকার পালা। ভীষণ সুন্দর ও কুল কিনারাবিহীন টাঙ্গুয়া আপনাকে মোহিত করে রাখবে। জানিনা আপনারা বর্ষায় যাবেন কিনা, আর গেলেও মেঘ পাবেন কিনা। বর্ষায় টাঙ্গুয়া অন্যরকম, আপনার ভয় হতে পারে। যেন রাগে ফুসছে। দূরে দেখতে পাবেন কালো হয়ে আসা আকাশ, ঝরছে অঝর ধারায় বৃষ্টি অথচ আপনার এখানে এখনও মেঘ এসে পৌছায়নি। চিন্তা নেই, আপনাকে টাঙ্গুয়া ওদিকেই হাতছানি দিয়ে ডেকে নিয়ে যাবে। দয়া করে খালি গায়ে বৃষ্টিতে ভিজবেন না কারণ সুঁইয়ের মত গায়ে বিধবে টাঙ্গুয়ার বৃষ্টি।
আমরা নিকটবর্তী আনসার ক্যাম্পে যখন পৌছলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ভাবলাম এখানে পানিতে নামাটাই নিরাপদ হবে যদিও ব্যাপারটা কারোই পছন্দ হচ্ছিল না, কিন্তু কিছু করার নাই। আমরা আসতে অনেক দেরী করে ফেলছি। ওখানেই বৃষ্টির মধ্যে টাঙ্গুয়াতে নেমে পড়লাম। গোসল করলাম। ইতিমধ্যে গ্রামে থাকা হাশেমের (আমাদের গাইড প্লাস মাঝি প্লাস আমাদের সিকিউরিটি) ভাগ্নের বাসা থেকে রান্নাবান্নার সরঞ্জাম ও নৌকায় থাকার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনার কাজ চলছে। সব কিছু হয়ে গেলে আবার নৌকা ছেড়ে দেয়া হল। ভেড়ানো হলো হাওড়ের মাঝে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা গাছের সাথে। এমনভাবে ভেড়ানো হল যাতে ঢেউয়ের ধাক্কায় নৌকা চারদিকে ঘুরতে পারে। তারপর মাঝিরা ব্যস্ত হয়ে গেল রান্না নিয়ে আর আমরা গান-বাজনা নিয়ে। রাতের প্রায় ১১টার দিকে খেয়ে নিলাম। ম্যেনুঃ ভাত, খাসির মাংস, হাওড়ের ছোট মাছ। খেলাম ইচ্ছামত, খাওয়া দাওয়া শেষে চা বানালাম। চা –সিগারেট খেয়ে আরো কিছুক্ষণ গান-বাজনা, আড্ডা দিয়ে রাত প্রায় ২:৩০ মিনিটে শুয়ে পড়লাম।
কিন্তু ঘুমিয়ে গেলেন তো মজা শেষ হয়ে গেল। রাতে টাঙ্গুয়া অন্যরকম। আপনি ছাড়া কেউ জেগে নেই। ঢেউয়ের শব্দে আপনি ভয় পেলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। নৌকার ভেতরে থেকে মনে হবে এই বুঝি উল্টে গেল। তুষার মনে হয় পুরা রাতই জেগে ছিল। বেচারা ভয়ে ঘুমাইতে পারে নাই। মামুন ভাইকে সকাল ৫:৩০ মিনিটে ডেকে তুলছিল, ডাকে সাড়া দিতে যাবে নৌকা ভেড়ানোর জন্য।
টাঙ্গুয়ার রাত খুব আঁধার নয়। অদ্ভুত এক আলোয় আলোকিত হয়ে থাকে, শহুরে লাইটের আলোয় যা কোনদিন আমাদের চোখ দেখতে পায় না, তাই ধরা দিতে একটু সময় নেবে কিন্তু দেখতে পাবেন অবশ্যই। কিন্তু ঘুম একসময় জিতেই যাবে। আমার ক্ষেত্রেও তাই হলো।

২৯শে জুন, ২০১৩, শনিবারঃ

20130628_180422
সকাল ৮ টা কি ৯টা। ঘুম ভাঙতেই শুনি নৌকার ইঞ্জিন চলছে। মুখে পানি দিয়ে বের হয়েই তো অবাক। চারদিকে ফকফকা রোদ, নীলাকাশ, স্বচ্ছ হালকা সবুজ পানি, দূরে আবছা পাহাড়ের সীমানা। এক কথায়, অদ্ভুত, অবর্ণনীয় শোভা। কিন্তু পেট বরাবরই চোখের সাথে জিতে যায়। পেটকে বধে আনতে চাই খাদ্য, তাই খিচুড়ী নিয়ে ঝাপিয়ে পড়লাম। খাওয়া শেষে, হাওড়ের মাঝে নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ করে দিয়ে দুপুরের রান্নার আয়োজন করা হচ্ছিল। কেউ খেয়াল করিনি স্রোতের সাথে ভাসতে ভাসতে নৌকা প্রায় হাওড় পাড়ি দিয়ে অপর দিকের গ্রামের কাছে চলে আসছে। রান্নার আয়োজন শেষ করে পানিতে নামার জন্য সাইনবোর্ড খুজতে গিয়ে দেখি, কোথায় কার সাইনবোর্ড। আর ১০ মিনিট ভেসে গেলেই হলুদ পানিতে গিয়ে পড়তে হবে। যাই হোক, আবার উল্টোদিকে ছুট দিলাম আমরা। প্রায় ৪০ মিনিট যাওয়ার পর নামার মত পছন্দনীয় জায়গা পেলাম। গভীরতা বেশী হলে ৫ ফুট কি সাড়ে পাঁচ, স্বচ্ছ সবুজ পানি। এতই স্বচ্ছ যে পানিতে দাঁড়িয়ে পা দেখা যায়। মামুন ভাইয়ের বুদ্ধিতে লাইফ জ্যাকেট খুলে, তার উপর শুয়ে পড়লাম। কাজটা বেশ কঠিন যদি না টেকনিক জানা থাকে। ভাসতে থাকলাম ঢেউয়ের সাথে, সে এক অন্যরকম অনুভুতি। হঠাৎ একটু ভয়ই পেয়ে গেলাম, দেখি নৌকা থেকে বেশ দূরে চলে এসেছি। কিন্তু ভরসা পেয়ে গেলাম, দেখি হাশেম আমাদের সাথেই আছে। ব্যাকস্ট্রোক করে পৌছে গেলাম নৌকার কাছে কিন্তু স্রোতের প্রতিকুলে বেশ কষ্টসাধ্য কাজ বলে মনে হল। যাই হোক, এক সময় গোসল শেষ করে নৌকায় উঠে পড়লাম।
আবার ছোটা শুরু করলাম। দুপুরের খাওয়া খাব, দেখি খাওয়ার পানি শেষ। নৌকা ছুটল নিকটবর্তী বাজারের দিকে। বাজার থেকে পানি কিনে, খেতে বসলাম। খাওয়া শেষে, সবাই আবার ছাদে উঠে পড়লাম। টাঙ্গুয়াকে বিদায় দিতে হচ্ছে। সামনে ঢলের পানি, হলুদ বর্ণের। বিদায় টাঙ্গুয়া। পৌছে গেলাম তাহেরপুর। ঘড়িতে তখন আড়াইটা। তাহেরপুর থেকে একটা লেগুনা রিজার্ভ করলাম। সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। হঠাৎ কেমন জানি খারাপ লেগে উঠল। মাঝিদেরকে তাদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দিলেন মামুন ভাই, বকশিস দেয়া হল আরও ১৫০০ টাকা। যাই হোক, বিদায়।
সুনামগঞ্জ পৌছলাম ৪টার দিকে। সুরমা পাড়ি দিয়ে, মাইক্রোবাস ভাড়া করে সিলেট পৌছলাম সন্ধ্যা ৭টায়। রোদে পুড়ে লাল হয়ে আছি, ক্লান্তি চেপে ধরেছে কিন্তু হৃদয় তৃপ্ত, পরিপূর্ণ ও একঘেয়েমী মুক্ত।

পরিবহনঃ
গন্তব্যঃ সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ। বাহনঃ মাইক্রোবাস। ভাড়া করার স্থানঃ মাজার গেইট, সিলেট। ভাড়াঃ ১৩০০ টাকা
গন্তব্যঃ সুনামগঞ্জ থেকে টেকেরঘাট। বাহনঃ মোটরবাইক। ভাড়া করার স্থানঃ সুনামগঞ্জ ঘাট। ভাড়াঃ ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা প্রতিটি
গন্তব্যঃ টাঙ্গুয়ার হাওড়। বাহনঃ নৌকা (ইঞ্জিনচালিত, কমপক্ষে ৩০ জন থাকা যাবে)। ভাড়া করার স্থানঃ অজানা (ভাড়া করা ছিল)। ভাড়াঃ ২ দিনের কন্ট্রাক্ট ৮০০০ টাকা
ফেরার পথেঃ
গন্তব্যঃ তাহেরপুর থেকে সুনামগঞ্জ। বাহনঃ লেগুনা। ভাড়া করার স্থানঃ তাহেরপুর। ভাড়াঃ ৯০০ টাকা
গন্তব্যঃ সুনামগঞ্জ থেকে সিলেট। বাহনঃ মাইক্রোবাস। ভাড়া করার স্থানঃ সুনামগঞ্জ বাস কাউন্টার ফেলে একটু সামনে। ভাড়াঃ ১৫০০ টাকা

পুরো রাস্তাঃ ঢাকা-সিলেট-সুনামগঞ্জ-টেকেরঘাট-টাঙ্গুয়ার হাওড়-তাহেরপুর-সুনামগঞ্জ-সিলেট।

পরামর্শঃ
– তাহেরপুর দিয়ে যাবেন, কষ্ট কম হবে কিন্তু মজাও কম হবে।
– টর্চ নিয়ে নিবেন।
– বিছানার চাদর নিয়ে নিবেন যদি হাওড়ে থাকতে চান।
– অডোমস নিয়ে যাবেন যদি শীতকালে যান এবং শীতের কাপড় নিতে ভুলবেন না। একটু বেশী-ই নিন, আরা আমার মত শীতকাতুরে।
– বর্ষাকালে হাওড়ে পানি খুব বেশী থাকে এবং যে কোন মুহুর্তে হাওড় বেশ বেকায়দায় ফেলে দিতে পারে আপনাকে। তাই বুঝেশুনে যাবেন ও ঘুরবেন।
– বর্ষাকালে ছোট নৌকা নিয়ে না যাওয়াই ভালো।