ভ্রমণপিপাসা

আমাকে কাছের অনেকেই প্রশ্ন করে, তুই ঘুরে কি মজা পাস? তাও এত কষ্ট করে বাইক চালায়ে, রোদ, ঝড়, বৃষ্টি, শীতের মধ্যে কই কই যাস, কি মজা পাস? লেখাটা আমার উপলব্ধি নিয়ে, আপনার ক্ষেত্রে একেবারেই ভিন্ন উপলব্ধি হতে পারে…

ভ্রমণের ক্ষুধা আসলে আমার তেমন নেই 🥴, আমি নতুনত্ব পছন্দ করি তাই নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে পরিচিত গন্ডি ছেড়ে বের হয়ে যেতে চাই। কখনই এক গন্ডিতে নিজেকে আটকে রাখতে নারাজ আমি। সেই তাড়না থেকেই আসলে এদিক সেদিক ঘোরার শুরু কিন্তু ঘুরতে ঘুরতে সম্পূর্ণ ভিন্ন নেশায় ধরে গিয়েছে…জীবনের গল্প জোগাড় করা…

কিশোরগঞ্জ যাচ্ছি, বাইকের সমস্যা হচ্ছে বারবার ব্যাটারী চার্জ ফুরায়ে যাচ্ছে ফলে চার্জ দিতে হচ্ছে ঘন্টা খানেক পর পর। শুক্রবার ফলে দোকানপাটও তেমন খোলা নেই। নরসিংদি পার হয়ে, চালাকচর বাজারের এক দোকানে বসে আছি। বাহিরে হালকা বৃষ্টি পড়ছে। রাস্তায় পানি জমে আছে এক হাটু… বেশ বয়স্ক একজন বৃদ্ধা, কেবল শাড়ি পরে সেই বৃষ্টির মাঝে জমাট জলের ধার ঘেষে হেটে হেটে আসছেন, দেখেই মনে হলো, “আমি ভাবতেছি আমিই ভীষণ বিপাকে আছি। কি মধুর সমস্যা আমার”… দোকানের সামনে আসতেই ওনাকে জিগেস করলাম আসয় বিষয়। ওনাকে দেখার কেউ তেমন নেই, নাতি আছে তাও ছোট… আমার ভীষণ হাসি পাচ্ছিল, এই কিছুক্ষণ আগের নিজের সমস্যা নিয়ে ব্যাতিব্যাস্ত, হাসফাস করা আমাকে নিয়ে। কতটুকু কি করতে পারলাম জানি না তবে আমার জন্য দোয়া করতে বলে বিদায় নিলাম।

নামাজ পড়ব কোথায় ভাবছি কারণ শুনশান রাস্তা, আশেপাশে একটা ঘরও নাই। মসজিদই বা কই থাকবে…আর এই জায়গায় মাইক কি আর থাকবে যে আযান শুনতে পাব আর মসজিদ খুজে পাব… রাস্তারও যা ছিরি, কোনদিকে তাকাবার উপায়ও নেই… এমন সব ভাবতে ভাবতে এগোচ্ছি, আর একটা ছোট ঘর দেখে দাড়ালাম, আশেপাশে মসজিদ আছে কিনা জিগেস করবো, দেখলাম ঐটাই মসজিদ কারণ আযান দিতে তৈরী হয়েছেন মুয়াজ্জিন…

দেখেছি, ঠিকমত সিজদা দিয়ে বসতে পারেন না, হামাগুড়ি দেয়ার মত করে বসেন কিন্তু নামাজ পড়ছেন…মানসিক প্রতিবন্ধি কিন্তু নামাজ পড়ছেন…দেশের আনাচে কানাচে এত রকম জীবনের মুখোমুখি হয়েছি কিন্তু কোথাও নিজেকে এগিয়ে রাখতে পারিনি।

না হয়েছি হাইল্লা, না হয়েছি জাইল্লা…

দেখা হয়েছিল অনীল চন্দ্র বর্মণ, একজন পান ব্যবসায়ীর সাথে…গল্প করেছি জেনেছি তার জীবনের কাহিনী। পাঁচ সন্তানের গর্বিত পিতা, ছেলেরা ডাক্তার হয়েছে, মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন, নিজেও দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছেন।

নানাবিধ জীবনের এই যে সংমিশ্রণ তা ভ্রমণে না গেলে কোণদিন জানা সম্ভব ছিল না, অনুধাবণ হতো না নিজের নগণ্যতাকে।

জায়গাটা কখনোই আমার জন্য মূখ্য নয়, মূখ্য হয় এই জীবনের নানা গল্পগুলোই…

সে এক অন্যরকম অনুভূতি। গাজীপুর বাইপাস, পুরা রাস্তা জ্যাম কিন্তু বাইক যেতেই পারে তারপরো চা খেতে বসে দোকানদার দাদুর দাদীর সাথে নানা খুনসুটি সে এক অন্যরকম আবেগ জাগাবে।

তাড়াহুড়ো করে কখনও পাবেন না এসবের স্বাদ, দেখতে পাবেন না নিজের সীমাবদ্ধতা আর সীমাবদ্ধতাকে ডিঙ্গাতে না পারলে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করাটাই স্বাভাবিক। কত সাধারণ মানুষ যে কত দিক দিয়ে আপনার আমার থেকে উর্ধ্বে কিংবা উন্নত তা গল্প বলে বোঝানো দুষ্কর, তাই বেরিয়ে পড়ুন সময় পেলেই…

সামান্য কটা টাকা ব্যায় করে এর চেয়ে বেশি রিটার্ন আর কিছুতে আসে বলে মনে হয় না।

ভাল থাকবেন। জীবনের গল্প গুলো সবসময়ই সতেজ, সুন্দর, সুস্বাদু, স্বাস্থ্যকর যদি তরতাজা ক্ষেত থেকে তুলে নিতে পারেন…